
মু. রিয়াজুল ইসলাম লিটন, সিনিয়র রিপোর্টার
গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আগামীকাল শুক্রবার শুরু হচ্ছে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে তাবলিগ জামাত ইজতেমা। আজ বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে শুরু হবে আঞ্চলিক বয়ান।
মুসল্লিদের পদচারণায় গতকাল থেকেই মুখর হয়ে উঠছে তুরাগতীর। মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রস্তুত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। ইজতেমার সার্বিক প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান। ইজতেমার প্রথম পর্ব ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় পর্ব হবে ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি।
প্রথম পর্বের ইজতেমায় মাওলানা জোবায়ের পক্ষের অনুসারীরা এবং দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা অংশ নেবেন।
জানা গেছে, কাল বাদ ফজর আ’ম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি জোহরের নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে ইজতেমার প্রথম পর্ব। ৪ দিন বিরতি দিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। ১১ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।
ছুটি বাতিল
ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের চিকিত্সা নিশ্চিত করতে টঙ্গী আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত সব চিকিত্সক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
দুই মুসল্লির মৃত্যু
গতকাল ইজতেমায় এসে ও আসার পথে দুই মুসল্লি অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তাঁরা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌহদ্দীটোলা গ্রামের জামান মিয়া (৪০)ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার ধামাউরা গ্রামের ইউনুছ মিয়া। তাঁদের টঙ্গী শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ডা. ফারহানা তাসনিম নিতু বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তাঁরা মারা যান।
আসছেন ভারতীয় মুসল্লিরা
ইজতেমায় যোগ দিতে ভারতের ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য থেকে মুসল্লিরা আসছেন বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে। গতকাল পর্যন্ত এক হাজারের মতো ভারতীয় মুসল্লি এসেছেন বলে ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে।
আইজিপির পরিদর্শন ও ব্রিফিং
গতকাল দুপুরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় কোনো জঙ্গি বা নাশকতা হামলার গোয়েন্দা তথ্য নেই। তবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। ইজতেমাকে ঘিরে যেন কোনো নাশকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। মুসল্লিদের উদ্দেশে আইজিপি বলেন, ইজতেমাস্থলে কারো কোনো সমস্যা হলে এলাকাভিত্তিক থানা-পুলিশ, ডিএমপিকে, র্যাব কন্ট্রোলরুমে জানাতে পারেন। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে জানাতে পারেন।আইজিপি বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় পুলিশের প্রায় ১৫ হাজার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। পুলিশের সব ইউনিট আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন কেউ গুজব তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সাইবার টহল টিম জোরদার করা হয়েছে।
৭ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা
ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন শেষে গতকাল র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ইজতেমাকে ঘিরে কোনো নিরাপত্তাঝুঁকি নেই। র্যাবের পাঁচটি ব্যাটালিয়নের (১, ২, ৩, ৪ ও ১০) সমন্বয়ে আকাশপথে হেলিকপ্টার টহল, ডগ স্কোয়াড টিম, ফুট প্যাট্রলিং, মোবাইল টিম, টহল টিম, নৌ টহল, সাইবার মনিটরিংসহ সাত স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকছে এবার বিশ্ব ইজতেমায়।
ইজতেমা ময়দানের মাইকের জিম্মাদার প্রকৌশলী আশরাফ আলী জানান, মুসল্লিদের সুষ্ঠুভাবে বয়ান শোনার জন্য পুরো ময়দানে শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক প্রায় ২শ বিশেষ ছাতা মাইক, ৫০টি ইউনিসেফ (প্রতিধ্বনি প্রতিরোধক) মাইকসহ প্রায় আড়াইশটি মাইক স্থাপন করা হয়েছে।
দেশ-বিদেশের মুসল্লিদের অবস্থান
বুধবার থেকেই লাখ লাখ দেশি-বিদেশি ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ময়দানে তাদের নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে লাল মিয়া, হাসান আলী, আসলাম মিয়া, মাহিম ও বাবুলসহ ১৭ জনের একটি জামাত ময়দানে এসেছেন।
মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম :
টঙ্গী শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষ্যে অস্থায়ীভাবে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবায় বক্ষব্যাধি/অ্যাজমা ইউনিট, হৃদরোগ, ট্রমা (অর্থোপেডিক), বার্ন, ডায়রিয়া ইউনিট, স্যানিটেশন টিম ও ২০টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও চক্ষু, মেডিসিন ও সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞসহ ১০০ চিকিৎসক রোস্টার অনুযায়ী চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
একই খিমায়
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ থাকলেও বিশ্ব ইজতেমায় তাঁরাসহ সাত দেশের মুসল্লিরা একই খিমায় (তাঁবু) অবস্থান করছেন। অন্য দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ইরান।
ময়দানে জেলাভিত্তিক খিত্তা
গাজীপুর-খিত্তা ১, টঙ্গী-২, ৩ ও ৪, ঢাকার মিরপুর-৫ ও ৬, সাভার-৭ ও ৮, মোহাম্মদপুর-৯, কেরানীগঞ্জ-১০ ও ১১, কাকরাইল-১২ থেকে ১৫ ও ১৮, ২০, ২১, যাত্রাবাড়ী-১৬ ও ২৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২২, নওগাঁ-২৩, নাটোর-২৪, টাঙ্গাইল-২৫, ঢাকার নবাবগঞ্জ-২৬, ধামরাই-২৭, সিরাজগঞ্জ-২৯, ঢাকার দোহার-৩০, রংপুর-৩১, নীলফামারী-৩২, জয়পুরহাট-৩৩, গাইবান্ধা-৩৪, বগুড়া-৩৫, লালমনিরহাট-৩৬, দিনাজপুর-৩৭, নারায়ণগঞ্জ-৩৮ ও ৩৯, নড়াইল-৪০, মুন্সীগঞ্জ-৪১, বরিশাল-৪২, ঝালকাঠি-৪৩, ভোলা-৪৪, নরসিংদী-৪৫, যশোর-৪৬, সাতক্ষীরা-৪৭, বাগেরহাট-৪৮, চুয়াডাঙ্গা-৪৯, মেহেরপুর-৫০, জামালপুর-৫১ ও ৫২, ময়মনসিংহ-৫৩ ও ৫৫, কুষ্টিয়া-৫৪, শেরপুর-৫৬, নেত্রকোনা-৫৭, কিশোরগঞ্জ-৫৮, গোপালগঞ্জ-৫৯, খাগড়াছড়ি-৬০, রাঙামাটি-৬১, ফরিদপুর-৬২, বান্দরবান-৬৩, কক্সবাজার-৬৪, পিরোজপুর-৬৫, হবিগঞ্জ-৬৬, সিলেট-৬৭, সুনামগঞ্জ-৬৮, ফেনী-৬৯, নোয়াখালী-৭০, লক্ষ্মীপুর-৭১, চাঁদপুর-৭২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৭৩, খুলনা-৭৪, পটুয়াখালী-৭৫, বরগুনা-৭৬, চট্টগ্রাম-৭৭ ও ৭৮, কুমিল্লা-৭৯। এছাড়া তুরাগ নদের পশ্চিম পাড়ের ময়দানে ঝিনাইদহ-৮০, মাগুড়া-৮১, কুড়িগ্রাম-৮২, ঠাকুরগাঁও-৮৩, পাবনা-৮৪, মানিকগঞ্জ-৮৫, মৌলভীবাজার-৮৬, পঞ্চগড়-৮৭, মাদারীপুর-৮৮, শরীয়তপুর-৮৯, রাজবাড়ি-৯০। বধিরদের জন্য ৯১নং খিত্তা রাখা হয়েছে। এছাড়াও ১০১ থেকে ১০৫ পর্যন্ত ৫টি খিত্তা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। বিদেশি মেহমানরা বরাবরের মতো এবারও ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়েছেন।
৪ দিন বিরতি দিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। ১১ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।