
ডেস্ক রিপোর্ট : রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা; যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের শান্ত-স্নিগ্ধ যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সকল পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে।’
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) বিকালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এসব কথা বলেন। নির্বাচন বর্জনকারী দলসমূহ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে জানিয়ে তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। সরকারও এক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।’
সংসদকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করতে সবার প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে দেওয়া এই প্রথম ভাষণে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না।’
অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্যের সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদেরসহ সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা। এ ছাড়াও অতিথিদের গ্যালারিতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সারা কুকসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা।
ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। ভবিষ্যতে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।’
আর্থিক খাতের সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনগণের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা।’
একটি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী ও গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানিয়ে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনা করায় দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই, জনগণের রায় মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব আমাদের ওপরও পড়বে। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কৃষি খাতের উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি নিশ্চিত করার জন্য উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের পণ্যসমূহ রপ্তানি বাজারে যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি সম্ভব হয়।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্রবিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সকল পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে।’
দীর্ঘ ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘করোনা অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও প্রায় দেড় দশক ধরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ছয় দশমিক সাত শতাংশের বেশি। এ সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় পাঁচগুণ বেড়ে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার এবং জাতীয় বাজেটের আকার নয়গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকায়।’
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘উন্নয়নের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। গত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বজায় থাকার কারণে দেশের এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। উন্নয়নের এ গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সমাজের সকল নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও সংগঠনের চাওয়া-পাওয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমন্বয়সাধন করতে হয় জাতীয় সংসদকে। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ—আইন প্রণয়ন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিসমূহে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য আমি এমপিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।’
বিরোধী দলের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ, মত-পথের ভিন্নতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না।
প্রথম অধিবেশনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন
সংসদের প্রথম অধিবেশনের জন্য ৫ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচন করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার প্রথম অধিবেশন শুরুর পর নতুন স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ সময় তিনি এই অধিবেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন।
প্রথম অধিবেশনের জন্য ৫ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা হলেন ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, আফম রুহুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও উম্মে কুলসুম স্মৃতি। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে নামের অগ্রবর্তিতা অনুসারে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা সংসদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শোক প্রস্তাবটি পেশ করেন। শোক প্রস্তাবে কুয়েতের আমির শেখ নাওয়াফ আল আহমদ আল জাবের আল সাবাহ’র মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
এ ছাড়া শোক প্রস্তাবে সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেসা তালুকদার, সাবেক সংসদ সদস্য ড. মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীসহ বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। পরে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হুসামুদ্দিন আহমেদ।