
নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী—দেশের সর্ববৃহৎ মাল্টিস্তরভিত্তিক শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী হিসেবে—সদস্যদের কল্যাণ,কর্মসংস্থান,দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অপারেশনাল সক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে এক নতুন দিগন্তের পথে যাত্রা শুরু করেছে।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা,দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কল্যাণমুখী রেশন পরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে বাহিনীর কার্যকারিতা ও সদস্যদের জীবনমানে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমে ইতোমধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বুধবার (৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি এবং গ্রামীণ ডিজিটাল হেলথকেয়ার সল্যুশনস (জিডিএইচএস)-এর মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এই চুক্তির আওতায় বাহিনীর সকল সদস্যদের মধ্যে বৈষম্যহীন মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে ‘সুখী’ অ্যাপের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।
এই সেবার আওতায় রয়েছে ভিডিও কনসালটেশন,হোম ল্যাব টেস্ট,ওষুধ সরবরাহ,মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন পরিচর্যা,অ্যাম্বুলেন্স সংযোগ,হাসপাতাল সেবা এবং ব্লাড ব্যাংক সেবাসহ আরও বিভিন্ন সেবা।
এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ,অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফিদা মাহমুদ এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গ্রামীণ গ্রুপের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আনসার ভিডিপি সদর দপ্তর অডিটরিয়ামে ‘দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকা’শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
এ সময় বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ উপস্থিত সদস্যাদের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন এবং বাহিনীর সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যত কর্মপন্থার বিষয়ে আলোকপাত করেন।
সেমিনারে আত্মকর্মসংস্থানে আনসার-ভিডিপির চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন উপমহপরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো.রফিকুল ইসলাম।
তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে আনসার ভিডিপি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে “প্রান্তিক শক্তি”নামক এন্টারপ্রাইজ গঠনসহ একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ গঠন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের সফল উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
বাহিনীর মানবসম্পদ ও উদ্যোক্তা ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় সহজ অর্থায়নের মাধ্যমে তরুণরা নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে কিংবা সম্প্রসারণ করতে পারছে, যা আত্মকর্মসংস্থানের একটি কার্যকর ভিত্তি নির্মাণ করছে।
প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে আরও অধিকতর সফলতা অর্জনে বাহিনী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। এই অংশীদারিত্বের ফলে সম্পদের যৌথ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও সহজতর হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য কিছু সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে বিটাকের সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণ, শোভলের মাধ্যমে হসপিটালিটি ও আইটি প্রশিক্ষণ, ইকো সাউন্ডের মাধ্যমে ৬জি ওয়েল্ডিং, শ্রেডারের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকনোগ্রাম লিমিটেডের সঙ্গে আউটসোর্সিং ও আইটি এবং এমিনেন্স ওভারসীজের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ায় ভাষা শিক্ষা।
এছাড়া, জিআইজেডর সহায়তায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন পথও উন্মোচিত হচ্ছে। আরও বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যা ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানে নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক হবে।
ইতোমধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মেয়াদে ১১১ জন ভিডিপি সদস্যা ৩ মাসব্যাপী ৯টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। এই প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোর মধ্যে ছিল মেশিন সপ, মোবাইল সার্ভিসিং, অটোক্যাড, রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের অনেকে দেশের খ্যাতনামা কোম্পানিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন, যেমন এসিআই ইলেকট্রনিক্সে ৫ জন, ম্যাটাডোর গ্রুপে ১৯ জন, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডে ৫ জন এবং প্রাণ-আরএফএলে ৫৯ জন সদস্যা।
এই উদ্যোগটি বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে দৃশ্যমান গৌরবজ্বল দৃষ্টান্ত ও ব্যাপক অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া, বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) সঙ্গে আনসার-ভিডিপির একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যার আওতায় বাহিনীর প্রায় ৮৫ হাজার সদস্য ও সদস্যা বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করবেন।
তৃণমূল পর্যায়ে বাহিনীর সদস্যদের জন্য রেশন ও বিভিন্ন উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট সরবরাহ ব্যবস্থাকে কার্যকর ও আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে আনসার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে রেজ্ঞ/জেলায় পরিবহনযান সরবরাহ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল রেঞ্জে ৫ টন ধারণক্ষমতার লরি এবং রাজশাহী ও খুলনা রেঞ্জে ৩ টন ধারণক্ষমতার একটি করে কাভার্ড ভ্যান হস্তান্তর করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ক্রমান্বয়ে আরও পরিবহনযান সরবরাহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর ফলে রেশন পরিবহনে গতি আসবে এবং মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কার্যক্রমে তাৎপর্যপূর্ণ সহায়তা প্রদান সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন আর শুধু একটি নিরাপত্তা বাহিনী নয়; বরং এটি একটি সম্ভাবনাময় জাতীয় সম্পদে পরিণত হতে পারে। দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা গঠনের মাধ্যমে এ বাহিনী দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাহিনী জাতীয় উন্নয়ন ও শান্তির অন্যতম অংশীদারে পরিণত হচ্ছে।
পরিকল্পিত উদ্যোগগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আনসার ও ভিডিপি কেবল অর্থনৈতিক অঞ্চল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সর্বোচ্চ সংখ্যক রেমিটেন্স যোদ্ধা তৈরি করে দেশের অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এই তিনটি উদ্যোগ—স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্হা সুসংগঠিতকরন —সম্মিলিতভাবে বাহিনীর সদস্যদের কল্যাণে একটি সমন্বিত কাঠামো গড়ে তুলবে, যা বাহিনীর সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং জাতীয় নিরাপত্তায় তাদের অবদানকে আরও সুদৃঢ় করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ডিআই/এসকে