
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠতি বয়সী তরুণীদের টার্গেট করে আকর্ষণীয় বেতন চাকরি,ট্যালেন্ট হান্টিং ও মডেলিংয়ের নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদে ফেলতো একটি চক্র। এরপর ব্যক্তিগত ছবি হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাক মেইল করে অনলাইনে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হতো। দীর্ঘদিন ধরে অতি কৌশলে শতশত তরুণীদের ফাঁদে ফেলে আধুনিক যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগে চক্রের মূলহোতাসহ ৮জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি ‘র সাইবার পুলিশ সেন্টার।
গ্রেফতারকৃতরা হলো-চক্রের মূলহোতা ও মেডিকেল শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসান (২৫) ও তার প্রধান সহযোগী খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন (২৬), মো.জাহিদ হাসান কাঁকন (২৮),তানভীর আহমেদ ওরফে দীপ্ত (২৬),সৈয়দ হাসিবুর রহমান (২৭),শাদাত আল মুইজ (২৯),সুস্মিতা আক্তার ওরফে পপি (২৭) ও নায়না ইসলাম (২৪)।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকা,সাতক্ষীরা,চাঁদপুর ও যশোরের বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে পর্ণগ্রাফি তৈরি ও তরুণীদের ব্ল্যাকমেইলে ব্যবহৃত ১২টি মোবাইল ফোন,২০টি সীম কার্ড,১টি ল্যাপটপ এবং আয়ের টাকা লেনদেনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও চেক বই জব্দ করা হয়েছে।
বুধবার (২৬ জুন) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহম্মদ আলী মিয়া।
তিনি বলেন,একটি চক্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া নামে ফেসবুক আইডি ও পেইজ খুলে ফ্রিল্যান্সিং কাজ,লোভনীয় চাকুরি,মডেল বানানো,মেধা অন্বেষণের নামে অল্প বয়সী তরুণীদের কাছ থেকে কৌশলে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে ব্ল্যাক মেইলের মাধ্যমে জোরপূর্বক তাদেরকে দেহব্যবসায় নামানোর ভয়ংকর এক চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি। এই চক্রটি মূলত উঠতি বয়সী তরুণীসহ যে সকল তরুণীরা পারিবারিক ভাঙ্গনের শিকার ও আর্থিক সমস্যা রয়েছে তাদের টার্গেট করত। চক্রটি কাজের সুযোগ দেওয়ার নামে ইন্টারভিউতে ডাকত। এরপর তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে সুযোগ দেওয়ার কথা বলে আপত্তিকর ছবি নিতো।
প্রাথমিকভাবে কাজে আগ্রহী তরুণীদের চাহিদা মতো টাকা ও প্রয়োজন মিটাতো তারা। এরপর ধিরে ধিরে অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করত তারা।
এই চক্রের মূলহোতা মেহেদী হাসান এবং তার খালাতো ভাই শেখ জাহিদ বিন সুজন মিলে এই চক্রটি গড়ে তুলেছিল। তারা দুজনেই মেডিকেল শিক্ষার্থী। তারা চিকিৎসা বিদ্যার আড়ালে অল্প বয়সী তরুণীদের ফাঁদে ফেলে যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট তৈরি ও টেলিগ্রাম,হোয়াটসঅ্যাপ এবং ম্যাসেঞ্জারে নানা অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করত। গত ৭ বছরে তারা প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেছে। এই টাকা দিয়ে তারা যশোর,সাতক্ষীরা,খুলনা এবং ঢাকায় বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেছে। নির্মাণ করেছে আলিশান বাড়ি। তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাংক একাউন্টেও বিপুল অর্থ জমিয়ে রাখার তথ্য মিলেছে।
যেভাবে কাজ করতো চক্রটি:
শুরুতে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাকরির বিজ্ঞাপন,কখনও মডেল তৈরি, কখনও বা ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ শীর্ষক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো চক্রটি। এতে যারা সাড়া দিত তাদের নিয়ে টেলিগ্রামে গ্রুপ খুলতো।
তারপর তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে বিদেশী বায়ারদের কাছে পাঠানোর কথা বলে মেয়েদের আপত্তিকর ছবি হাতিয়ে নিত চক্রটি। হাতিয়ে নেওয়া সেই সব অর্ধনগ্ন ছবি ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নগ্ন হয়ে ভিডিও কল বা সরসারি অসামাজিক কাজে বাধ্য করত। চক্রচির টেলিগ্রাম গ্রুপে হাজার হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। যারা একটি নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে ওই গ্রুপগুলোতে যুক্ত থাকতো।
চক্রটি ভিডিও কলের সব কিছু গোপনে ধারণ করে রাখতো। এরপর মেয়েদের বাধ্য করা হতো চক্রটি ভুক্তভোগীদের যৌণ সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্যকরত। এভাবেই চক্রটির হাতে আধুনিক যৌনদাসীতে পরিণত হয়েছিল শত শত তরুণী। দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার এই চক্রের মূল হোতা ও তার প্রধান সহযোগীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়,দেশ-বিদেশে চক্রটির রয়েছে শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক। নানা নামে তাদের শতাধিক চ্যানেলে গ্রাহক সংখ্যা কয়েক লাখ। বিভিন্ন বয়সী নারীদের ভিডিও কল ও দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে এবং গোপনে ধারণকৃত সেসব ভিডিও বিক্রি করে চক্রটি প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করেছে। অর্থ লেনদেনের জন্য তারা ব্যবহার করতো এমএফএস বা মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস। এছাড়া ক্রিপ্টো কারেন্সিতেও তাদের হাজার হাজার ডলার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের আড়াল করার সকল কলা-কৌশলও এই চক্রের জানা। ফলে শত শত মোবাইল সিম ব্যবহার করলেও তাদের কোনোটিই প্রকৃত ন্যাশনাল আইডি দিয়ে নিবন্ধন করা নয়। এক্ষেত্রে তারা নিম্ন আয়ের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিত। সামান্য অর্থ দিয়ে তোলা হতো সীম কার্ড।
কন্টেন্ট আদান-প্রদান ও সাবস্ক্রিপশনের জন্য ছিল টেলিগ্রাম প্রিমিয়াম একাউন্ট এবং বিভিন্ন পেইড ক্লাউড সার্ভিস। অল্প বয়সী ভয়ানক চতুর এই দুই মেডিকেল শিক্ষার্থীর জিম্মায় কয়েক হাজার নারী রয়েছে। আছে টিকটক,ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম সেলিব্রেটিও। অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপে গোপনে ধারণ করা প্রায় ১০ লক্ষ ন্যুড ছবি ও ২০ হাজার এডাল্ট ভিডিও এর সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ ঘটনা কতদিন ধরে চলছিল। টাকা পঁয়সার লেনদেন কীভাবে হচ্ছিল এবং ভুক্তভোগীর সংখ্যা কত এমন এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন,ওদের যে গ্রুপ রয়েছে সেটি সাবস্ক্রাইবার ১ লাখ ৮ হাজার। আমাদের কাছে অভিযোগ আসার পরে আমরা অনেক ভুক্তভোগীকে পেয়েছি। এ সংখ্যাটা এখনই আমরা বলতে চাচ্ছি না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,২০১৭ ও ২০১৮ সাল থেকে এই চক্রটি কাজ করে যাচ্ছে। এরা দুইজনই মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। তাদের একজন হলো ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ গাজিপুরে পড়াশুনা করে আরেকজনহ হলো ইবনে সিনায়।
তিনি বলেন,এখানে যারা সার্ভিস নিচ্ছে অবশ্যই এটাও অন্যায় ও বেআইনী। বাংলাদেশের পর্নোগ্রাফি আইন অনুযায়ী এটি অবৈধ। তাদেরকেও আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এখানে তিন ধরণের অপরাধ হচ্ছে,একটি হলো সাইবার ক্রাইম অপরাধ,ফেইক আইডি খুলে যে ফেইক বিজ্ঞাপন দিয়েছে এটিও এক ধরণের অপরাধ। বিজ্ঞাপন যে উদ্দেশ্য দেওয়া হচ্ছে সেটি মিথ্যা আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে সেটিও অপরাধ। তারপর পর্নোগ্রাফি করছে আরেকটি অপরাধ।
গ্রেফতার হওয়া চক্রের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।
ডিআই/এসকে