সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা বাংলাদেশে আরসার অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক ও কমান্ডার মো.শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিমসহ দুইজন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

বুধবার (১৫ মে) কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন লাল পাহাড়ে অভিযানে আরসার আস্তানা থেকে র‌্যাব-১৫ সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড ও রকেট সেল উদ্ধার করে।

বুধবার দুপুরে আস্তানার সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম।

তিনি বলেন,বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আরসা’র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা,অপহরণ,ডাকাতি,চাঁদাবাজি,অগ্নিসংযোগ ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে আরসার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এই আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর প্রভাব খাটায়। কেউ আরসার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলে কিংবা তাদের কথা না শুনলে তারা বেশিরভাগই অপহরণ ও হত্যা শিকার হয়। রোহিঙ্গা নাগরিক প্রর্ত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় ২০২১ সালে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ আরসার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছিল। এছাড়াও ২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‍্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সন্ত্রাসী হামলায় একজন র‌্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হয়।

কমান্ডার আরাফাত ইসলাম আরো জানান,রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে অদ্যাবধি পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এ সকল সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্মূলে র‌্যাব-১৫,কক্সবাজার শুরু থেকেই বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারী চালু রেখেছে। র‌্যাব বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সন্ত্রাস বিরোধী বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে আরসার সামরিক কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদ, অর্থ সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস,গান কমান্ডার রহিমুল্লাহ ওরফে মুছা অর্থ সমন্বয়ক মোহাম্মদ এরশাদ ওরফে নোমান চৌধুরী ও আবু তৈয়ব,কিলার গ্রুপের প্রধান নূর কামাল ওরফে সমিউদ্দিন,ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডার ওসমান গনি র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়।

এছাড়াও লজিস্টিক শাখার প্রধান,গান গ্রুপের প্রধান, অর্থ শাখার প্রধান এবং আরসা প্রধান নেতা আতাউল্লাহর দেহরক্ষী আকিজসহ মোট ১১০ জন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে ৫১ কেজি ৭১ গ্রাম বিস্ফোরক,১২টি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৩টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র,১৫৩ রাউন্ড গুলি -কার্তুজ,৬৭ রাউন্ড খালি খোসা,৪টি আইডি ও ৩৫টি ককটেল উদ্ধার করা হয়।

তিনি আরও বলেন,পার্শ্ববর্তী দেশে সৃষ্ট সংঘর্ষকে কাজে লাগিয়ে আরসাসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসার একটি তথ্য র‍্যাবের কাছে আসে। এছাড়াও আরসা নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ায় পুন:সংগঠিত হওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিছু নেতৃপর্যায়ে আরসা সদস্যকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়েছে বলে তথ্য পায় র‌্যাব।

এমন তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার ভোরে র‌্যাব-১৫ কার্যক্রম শুরু করে এবং জানতে পারে,মাস্টার সেলিম বর্তমানে বাংলাদেশের আরসার প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাশ সৃষ্টি করছে। এরই ধারাবাহিকতায়, র‌্যাব-১৫ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অবগত হয়ে আজ মঙ্গলবার ভোররাতে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন লাল পাহাড়ে আরসার আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আরসার অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক ও কমান্ডার মো.শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিম’সহ দুইজন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি গ্রেনেড,৩টি রাইফেল গ্রেনেড,১০টি দেশীয় তৈরি হ্যান্ড গ্রেনেড,১৩টি ককটেল, ১টি বিদেশী রিভলভার,৯ রাউন্ড ৯এমএম পিস্তলের এ্যামুনিশন,১টি এলজি এবং ৩টি ১২ বোর কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক,গ্রেনেড,আইইডি এবং রকেট সেল ধ্বংস করে। গ্রেফতারকৃত মো.শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিম (৩৮) মাস্টারের বাবার নাম সৈয়দুল আবেরা। মায়ের নাম ছুরিয়া বিবি। সলিম উখিয়া ১৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পর বাসিন্দা। মো.রিয়াজের (২৭) বাবার নাম মোহাম্মদ নুর। মায়ের নাম জোহরা বেগম। বালুখালী ৮/ডব্লিউ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্লক-এ/২৩ এর বাসিন্দা।

কমান্ডার আরাফাত ইসলাম আরো জানান, গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক। মো.শাহনুর প্রকাশ মাস্টার সলিম ২০১৭ সালের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং ক্যাম্প-১৫ এ বসবাস শুরু করে। সে পার্শ্ববর্তী দেশে থাকাকালীন সেখানকার জোন কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির দেহরক্ষী হিসেবে দুই মাস দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে ২০১৭ সালে আসার পর মৌলভী আকিজের মাধ্যমে আরসায় পুনরায় যোগদান করে।

আরসার হয়ে আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ,চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকের উপর পারদর্শী। প্রাথমিকভাবে ক্যাম্প-১৫ এর কমান্ডার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আরসা নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ায় সে বাংলাদেশে আরসার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব নেয়। পার্শ্ববর্তী দেশে সৃষ্ট সংঘর্ষের ফলে লুটকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ বিভিন্ন মাধ্যম হতে সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাশ সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুনরায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রিক মারামারি,সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। তার বিরুদ্ধে ৩টি হত্যা মামলাসহ অন্যান্য বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো জানান,গ্রেফতারকৃত মো. রিয়াজ ২০১৭ সালে বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বসবাস শুরু করে। সে ২০১৮ সালে মৌলভী মো. ইব্রাহিমের মাধ্যমে আরসায় যোগদান এবং প্রাথমিকভাবে আরসার হয়ে পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করে। এ সময় সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ আরসা বিরোধী সংগঠনের সদস্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করতো। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় পার্শ্ববর্তী দেশে ফিরে যায় এবং সেখানে ৬ মাসের সামরিক বিভিন্ন বিষয়াদিসহ মাইন, বোমা,হাত বোমা ও বিস্ফোরক তৈরিতে প্রশিক্ষণ লাভ করে। পরবর্তীতে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে গ্রেফতারকৃত মাস্টার সলিমের অন্যতম সহযোগী হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতো বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে ১টি হত্যা মামলা মামলা সংক্রান্তে তথ্য পাওয়া যায়।