ঘোড়াঘাটে মোজাম বিনোদন পার্কে প্রকাশ্য পতিতাবৃত্তি

72

মাহতাব উদ্দিন আল মাহমুদ, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাংলী দেখিয়ে চলছে মোজাম বিনোদন পার্কে প্রকাশ্য পতিতাবৃত্তি।স্থানীয় প্রশাসন ঘুমিয়ে।
নামে মাত্র মোজাম বিনোদন পার্ক! বিনোদন কেন্দ্রটির অবস্থান দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ১নং বুলাকীপুর ইউনিয়নের কালুপাড়া-বুলাকীপুর গ্রামে ।ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিনোদনপার্কের লাইসেন্স নিয়ে সেখানে প্রকাশ্য দেহ ব্যবসা করে আসছে পার্কটির মালিক মোজাম্মেল হক মোজাম। পার্কটিতে ঘটেছে একটি হত্যাকান্ডও। সব মিলিয়ে তার অসামাজিক এই কার্যক্রমে দিশেহারা গ্রামবাসী এবং বিব্রত স্থানীয় প্রশাসন এলাকাবাসীদের পক্ষ থেকে বারংবার পার্কটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করলেও, তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। তার অযৌক্তির যুক্তি এবং অদৃশ্য ক্ষমতার কাছে যেন সবাই হার মেনে নিয়েছে।
২ মার্চ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পার্কটিতে অভিযান চালায় ঘোড়াঘাট থানা পুলিশ। এ সময় অসামাজিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে এক পতিতা নারী সহ ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে সন্ধায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে উপজেলা নির্বাহী ্অফিসার (ইউএনও) এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাফিউল আলম ৩ জনকে এক মাসের কারাদন্ড প্রদান করেন।
সাজাপ্রাপ্তরা হলেন, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা গ্রামের ওসমান গনির ছেলে আনারুল ইসলাম (৩৫), রেজাউল মিয়ার ছেলে সোহান মিয়া (২৮) এবং অপর এক নারী হলেন মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ধোলুদিয়া কাসোরিয়া গ্রামের মৃত কামাল শেখের স্ত্রী সেতু আক্তার (২৫)।
থানা পুলিশ এবং উপজেলা প্রশাসন গত বছরের শুরু থেকে চলতি বছর পর্যন্ত পার্কটিতে ৮ বার অভিযান পরিচালনা করেছে। আটক হয়েছে খদ্দের সহ কয়েক জোড়া পতিতা নারী এবং পার্ক মালিক সহ তার জামাতা। মোবাইল কোর্টে তাদেরকে একাধিকবার জরিমানা ও সাজা দেওয়া হয়েছে। তাতেও দমিয়ে রাখা যায়নি পার্ক
মালিককে। সেখানে অভিযানে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশকে তিনি শেখান আইন। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করা হয়েছে বলে দাবি করেন পার্ক মালিক মোজাম্মেল হক মোজাম।
পার্ক মালিক মোজাম সব সময় তার কাছে অ্যাডভোকেট শাহিদা বেগমের লেখা ‘পতিতা আইন, অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন আইন ১৯৩৩’ নামের একটি বই এবং কুরআন শরিফের ‘সূরা আল নিসা’র একটি খন্ড নিজের কাছে রাখেন। পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে অভিযানে গেলে মোজাম্মেল এই দুটি বই থেকে দু’একটি লাইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে তাদেরকে বিব্রত করার চেষ্টা করে।
সরেজমিনে পার্ক ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়ক থেকে প্রায় ১
দশমিক ৫ কিলোমিটার দুরে দুই গ্রামের মাঝখানে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি বিশাল আমবাগান রয়েছে। বিনোদনের তেমন কিছু না থাকলেও নামে এটি মোজাম বিনোদন পার্ক।
পার্কটির শেষ অংশে দুই সারিতে ১০টি ইটের রুম রয়েছে।
প্রতিটি রুমে খাট সহ সংযুক্ত টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
রুমের ভিতর এবং এর চারপাশে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটের খোসা সহ যৌনকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী পড়ে আছে। মূলত পার্কটির এ সব রুমেই অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। আইনে এ সব বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করার তেমন কোন ক্ষমতা স্থানীয় প্রশাসনের না থাকায় অভিযান পরিচালনার মাঝেই নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখছেন উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
পার্কটির মালিক মোজাম্মেল বিনোদন কেন্দ্র পরিচালনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করলেও, সেই লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর। নবায়নের আবেদন করলেও, অসামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে নতুন করে লাইসেন্স নবায়ন করে দেয়নি ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ। আইন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৩৩ সালের ‘বংগীয় সর্বসাধারণের চিত্ত বিনোদন স্থান আইন’ অনুযায়ী এ রুপ বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কেবলমাত্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে। ওই আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া অথবা লাইসেন্সের শর্তাবলী লক্সঘন করলে লিখিত আদেশের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এছাড়াও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত আদেশে ক্ষমতা প্রাপ্ত যেকোন পুলিশ কর্মকর্তা এ সব বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।আইনের এই ৮ ধারায় বিনোদন কেন্দ্রের মালিক, ইজারাদার বা ব্যবস্থাপককে অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
গত বছরের আগষ্ট মাসের ১০ তারিখে মোজাম বিনোদন পার্কের একটি কক্ষে নৈশপ্রহরী সবুজ মিয়া (২৫) নামের এক যুবককে গলাকেটে হত্যা করে দুবৃত্তরা। এই ঘটনায় নিহতের পরিবারের করা হত্যা মামলায় পার্ক মালিক মোজাম এবং তার জামাতা সহ চারজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আবারো সেই পতিতাবৃত্তির ব্যবসা শুরু করে মোজাম। প্রকাশ্যেই বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ান তার পার্কে দাসীদেরকে ভোগ করা হয়।
স্থানীয় আবু তালেব মিয়া বলেন, ‘পার্কটির বর্তমান অবস্থা
দেখলে মনে হয় আমরা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে ফিরে গেছি। দিনরাত ২৪ ঘন্টা সেখানে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে প্রবেশ.করে। গ্রামে পরিবেশ বলে আর কিছু নেই। আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হতে বসেছে।’ অর্ধকোটি থেকে কিছু দুরেই একটি বাড়ির গৃহবধূ কুলসুম বেগমের। তিনি বলেন, ‘ বাড়িতে ছেলে মেয়ে আছে। তারা স্কুলে যাতায়াত করে। এই পার্কটি নিয়ে আমরা লজ্জায় আছি সন্তানদেরকে এমন পরিবেশে কিভাবে গড়ে তুলবো ভেবে পাই না। পার্কটির বিরুদ্ধে কেউ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।’ তার এই পতিতাবৃত্তি ব্যবসা বৈধ দাবী করে অভিযুক্ত মোজাম্মেল হক মোজাম বলেন, ‘২০০০ সালে হাইকোর্ট পতিতাবৃত্তি ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে। এছাড়াও আল কুরআনের সূরা আল নিসার ২৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ দাসিদেরকে ভোগ করা বৈধ করে দিয়েছেন।’
তিনি প্রকাশ্য পতিতাবৃত্তির ব্যবসা করেন কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি দেহ ব্যবসা করাই। আমার পার্কে রুম আছে সেগুলো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ঘন্টা চুক্তিতে ভাড়া দেই।
আমার এটা বৈধ ব্যবসা। পুলিশ ও ইউএনও আমার পার্ক থেকে বিনোদন নিতে আসা ছেলে মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যায়। আমি তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবো।’
১নং বুলাকীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সদের আলী খন্দকার বলেন, আমরা একাধিকবার পার্ক মালিককে ডেকে এ সব অপকর্ম না করার জন্য বলেছি। তাকে ইউনিয়ন থেকে যে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিলো, সেটি নতুন করে আমরা আর নবায়ন করে দেইনি।
ইউএনও এবং ওসি সাহেবকেও বিষয়টি অবগত করেছি। কিন্তু এই পার্ক মালিককে কোন ভাবেই দমানো যাচ্ছে না। আমরা বিব্রতকর একটি পরিবেশের মাঝে অবস্থান করছি।’
ঘোড়াঘাট থানার ্অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু হাসান কবির বলেন, ‘আমরা পার্কটিতে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি।
পার্কটির মালিক সহ তার জামাতা এবং অসামাজিক কাজে জড়িত নারী-পুরুষদেরকে মোবাইল কোর্টের আওতায় নিয়ে এসেছি। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি ওই এলাকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে।’ এদিকে ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রাফিউল আলম বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের মিটিং-এ এই পার্কের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পার্কটি বন্ধ করার ক্ষমতা কেবল মাত্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের রয়েছে। আমি জেলা প্রশাসক স্যারকে বিষয়টি
অবগত করেছি। পার্কটি দ্রুত বন্ধ করা এবং প্রয়োজনীয়
আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা লিখিত ভাবে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করবো।’