
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) তথ্যের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবাসহ ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৷
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা (৪১), মো. শরিফুল ইসলাম ওরফে মুরাদ (৩১), আশিকুর রহমান ওরফে উসাইমান (২৭), মুহাম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবরার (২৪), মো. আল আমিন ওরফে রবিন ওরফে সামুরা (২৪) ও মো. আবু জর ওরফে মারুফ (১৮)। এ সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ জিহাদী ও উগ্রবাদী বই এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদী।
র্যাব জানায়,রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
সোমবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হন তারা:
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতাররা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র সদস্য। তারা আফগানিস্থানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদেরকে তারা বিভিন্ন উগ্রবাদি পুস্তিকা, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতো তারা:
এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদরাসা ও সদস্যদের কাছে থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতো বলে জানা যায়। এছাড়াও তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং তারা সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণ করতো।
কে এই সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা-
গ্রেফতার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা দাখিল সম্পন্ন করেছেন। সে ২০১৫ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। সংগঠনে যোগদানের পর সে বিভিন্ন পেশার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে সে সংগঠনের রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রশিক্ষণ শাখার প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। তার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের বর্তমান আমিরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এবং তার নির্দেশেই তিনি রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
গোপনীয় অ্যাপস ব্যবহার করে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ:
র্যাবের মুখপাত্র আরও বলেন, গ্রেফতার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করতো। তার নির্দেশে সংগঠনের নতুন সদস্যদের গাজীপুর, টঙ্গী ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন আনসার হাউজে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় অ্যাপস ব্যবহার করে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো ও শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে নির্দেশনা নিতো এবং সংগঠনে তার অনুসারীদের সকল প্রকার দিক-নির্দেশনা দিতো।
এছাড়াও আব্দুর রাজ্জাক সংগঠনের সদস্যদের কাটআউট সিস্টেম সম্পর্কিত বিষয়ে মৌখিক এবং লিখিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতো এবং কাটআউট সিস্টেমের নীতিমালা মেনে চলার নির্দেশনা দিতো।
কমান্ডার মঈন বলেন, আব্দুর রাজ্জাক পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতো। তার নির্দেশনায় গ্রেফতার শরিফুল সংগঠনের বেশকিছু সদস্যকে তথাকথিত হিজরত ও বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে ছিল। আব্দুর রাজ্জাক ওরফে সাইবার নির্দেশনায় পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণকৃত ৪ জন সদস্য চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার আব্দুর রাজ্জাক কাশিমপুর কারাগারে গ্রেফতার আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতো এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেখা করিয়ে দিতো। এছাড়াও সে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করায় সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক সাইবা হিসেবে পরিচিত পায়।
কে এই গ্রেফতার আশিকুর রহমান:
গ্রেফতার আশিকুর রহমান একজন কুরআনের হাফেজ। সে ময়মনসিংহ এলাকায় হিজামার ব্যবসা করতো। সে ২০১৮ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে দাওয়াতী কার্যক্রম করতে থাকে।
পরবর্তীতে সে সংগঠনের ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম প্রধান সেকশন চীফ হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পাশাপাশি সে সংগঠনের জিহাদী প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে অন্যতম সমন্বয়ক ছিল। সে নতুন সদস্যদের সংগঠন ও তথাকথিত জিহাদ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য উগ্রবাদী পুস্তিকা সরবরাহ করতো।
গ্রেফতার সাইবার নির্দেশনায় সে সংগঠনের মাসুলদের অধীনস্থ হিসেবে নতুন সদস্যদের বন্টন করার দায়িত্ব পালন করতো। সে সংগঠনের বিভিন্ন সদস্যদের কারাতে প্রশিক্ষণ ও শারীরিক কসরত সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতো এবং প্রশিক্ষণকালীন সময় শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করতো।
কে এই জাকারিয়া:
গ্রেফতার জাকারিয়া ওরফে আবরার স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে হাফেজী পড়া সম্পন্ন করেন। সে ২০২০ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে। সে ভ্রাম্যমান রকমারি ব্যবসার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রম ও নতুন সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
পরবর্তীতে জাকারিয়া রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার এবং মানিকগঞ্জ জেলার সংগঠনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। সে গ্রেফতার আশিকুর রহমানের নির্দেশে কারাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ব্ল্যাকবেল্ট অর্জন করে। পরবর্তীতে জাকারিয়া সাইবার নির্দেশে সংগঠনের সদস্যদের সাভার ও গাজীপুর, টুঙ্গির বিভিন্ন আনসার হাউজে শারীরিক (কারাতে) প্রশিক্ষণ প্রদান করত। এছাড়াও সে নতুন সদস্য সংগ্রহসহ সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় এ্যাপস এর মাধমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করতো।
কে এই শরিফুল:
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতার শরিফুল স্থানীয় একটি হাফিজীয়া মাদ্রাসা হতে হেফজ সম্পন্ন করে। সে ২০১৮ সালে গ্রেফতারকৃত সাইবার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে দাওয়াতী কার্যক্রম করতে থাকে। পরবর্তীতে সাইবার নির্দেশে সে সংগঠনের ৪ জন সদস্যসহ ২০১৯ সালের প্রথম দিকে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও তথাকথিত জিহাদের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে গমন করে।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে শরিফুল অন্য সদস্যদের রেখে কৌশলে অবৈধ পথে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশে আসার পর সেখানে অবস্থানরত সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো এবং পুনরায় সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতো। সে গ্রেফতারকৃত সাইবার নির্দেশনায় সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরত ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণ করতো।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, শরিফুল সংগঠনের সদস্যদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের জন্য বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতো। এছাড়াও সে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে সভার আয়োজন করতো। শরিফুল তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণের জন্য সদস্য নির্বাচন ও প্রেরণ কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতো।
কে এই আল আমিন:
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার মো. আল আমিন ওরফে রবিন ওরফে সামুরা স্থানীয় একমটি মাদরাসা থেকে দাখিল সম্পন্ন করেন। সে ২০১৯ সালে রাকিবের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলাম সংগঠনটিতে যুক্ত হয়। সে মাদরাসায় শিক্ষকতার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে আল আমিন ২০২১ সালে আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র জন্য পার্বত্য এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের কাজ করতো। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অর্থ শাখার প্রধান গ্রেফতার মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবের নির্দেশে কেএনএফের প্রশাসন ও অর্থ শাখার পাসেন মিরাম নামক ব্যক্তির কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রেরণ করতো। এছাড়াও তার সঙ্গে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নেতৃস্থানীদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
কে এই আবু জর মারুফ:
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, গ্রেফতার মো. আবু জর ওরফে মারুফ স্থানীয় একটি মাদরাসায় জালালাইনে অধ্যয়নরত। সে ২০২২ সালে গ্রেফতার জাকারিয়ার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আনসার আল ইসলাম’ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে সে গ্রেফতার জাকারিয়ার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে তার নিজ এলাকায় দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
আদালত থেকে পলাতক আনসার আল ইসলামের দুই জঙ্গি পালানোর ঘটনায় গ্রেফতার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবার কোনো নির্দেশনা ছিল কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দুই জঙ্গি পালানোর বিষয়টি তিনি অবগত ছিলেন। কাশিমপুর কারাগারে আনসার আল ইসলামের গ্রেফতার সদস্য যারা আছেন তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতা করতেন। এছাড়া গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পেতেন আব্দুর রাজ্জাক।
ডিআই/এসকে