
সৌদি প্রবাসী স্বামী ১৭ জন বাংলাদেশীর ভিসার জন্য সৌদির কফিলকে ৩৫ লাখ টাকা দিয়েও ভিসা এবং টাকাও না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পরেন। স্বামীর এমন সমস্যা সমাধানে স্ত্রীর নজরে আসে জ্বীনের বাদশা তান্ত্রিক,শাস্ত্রিক জৈনপুরী মা ফাতেমার দরবারের সকল সমস্যার সমাধানের লোভনীয় চটকদার বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য জ্বীনের বাদশা ক্ষ্যাত প্রতারক চক্রের সাথে যোগাযোগ করেন সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী। এরপরই শুরু হয় প্রতারণা। শুরুতে কোন টাকা লাগবে না বলে জানানো হলেও সৌদি কফিল বাধ্য না হওয়ায় তাকে বাধ্য করার জন্য জ্বীন পরীকে সৌদি কফিলের কাছে যেতে জ্বীন পরীকে পাক পবিত্র করতে হবে বলে জানান প্রতারক চক্র। আর এর জন্য জন্য ভূটানী গরুর ২১ কেজি দুধ দিয়ে ধুয়ে জ্বীন পরীকে পবিত্র করতে হবে বলে জানিয়ে দুধ কেনা বাবদ চাওয়া হয় টাকা। একই ভাবে বিভিন্ন অযুহাতে ধাপে ধাপে হাতিয়ে নেয়া হয় ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্রটি। এমনই এক প্রতারক চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
রবিবার (২৫মে) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে পিবিআই কার্যালয়ে ‘জ্বীনের মাধ্যমে জোনপরী মা ফাতেমার সকল সমস্যার সমাধান চক্রের সদস্য গ্রেফতার সংক্রান্ত সংবাদ সন্মেলনে এসব জানান অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক মো.এনায়েত হোসেন মান্নান। ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো-মো. রাকিব (২০), মো.রাকিব মোল্লা (২৯), মো. আলাউদ্দিন।
মো.এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, তেজকুনীপাড়া তেজগাঁও এর গৃহবধূ রহিমা বেগম (৩৪) এর সৌদি প্রবাসী স্বামী ১৭ জন বাংলাদেশীর ভিসার জন্য ৩৫ লাখ টাকা কফিলকে দিয়ে ভিসাও পায়নি এবং টাকাও না পেয়ে যখন দিশেহারা হয়ে পরে। তখনই তার স্ত্রী জ্বীনের বাদশা তান্ত্রিক, শাস্ত্রিক জৈনপুরী মা ফাতেমার দরবারের সকল সমস্যার সমাধানের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারকচক্রের মিথ্যে নাটক ও প্রতারনার ফাঁদে পড়ে দাপে ধাপে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পরেন। পরে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানার একটি মামলা দায়ের করেন।
তিনি বলেন, মামলার বাদীর দাবী ১০ লাক ২০ হাজার টাকা প্রতারকের খপ্পরে পড়ে নেয়ার কথা উল্লেখ করলেও মামলা তদন্তকালে ও আসামীদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ্যে ইউটিউব চ্যানেলে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারনার ফাঁদ পেতে হাজার হাজার লোককে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে জানা যায়।
মানুষকে প্রলুব্ধ ও আকর্ষণ করার জন্য জ্বীনের বাদশা খ্যাত প্রতারকচক্র বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, চক্রটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কৌশলে বিপদগ্রন্থ মানুষকে সব সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখায়। বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হয়ে তাদের দেয়া নম্বরে ফোন করলে তারা তখন জানায়, তারা সকল সমস্যার সমাধান, পাওনা টাকা আদায়, স্বামীর সাথে মিল, প্রেমিকাকে পাইয়ে দেওয়া, ঝগড়া বিবাদ মিট করা, মামলা মোকাদ্দমায় জয়ী করা, গুপ্তধন পাইয়ে দেওয়া, লটারীতে বিজয়ী করা, কোটি কোটি টাকার মালিক বানিয়ে দেওয়া, কঠিন রোগ হতে আরোগ্য লাভ করা, পাওনা টাকা আদায় করা, আকামা লাগিয়ে দেওয়া, ভিসা পাইয়ে দেওয়া, ভাগ্য পরিবর্তন করে দিবেন ইত্যাদি।
প্রতারনা করার উদ্দেশ্যে সৌদি কফিলকে বাধ্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে মেডিসিন হিসেবে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কাপ সিন্দুর লাগবে জানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।
পরে আবার সৌদি কফিল বাধ্য না হওয়ায় তাকে বাধ্য করার জন্য জ্বীন পরীকে সৌদি কফিলের কাছে যেতে জ্বীন পরীকে পাক পবিত্র করতে হবে। এই জন্য ভূটানী গরুর ২১ কেজি দুধ দিয়ে ধুয়ে জ্বীন পরীকে পবিত্র করতে হবে। কফিলকে বাধ্য করতে বাদীকে রতাময়ী শ্রী আংটি পড়তে হবে। আংটি জ্বীনেরা বাদীর কাছে পৌছে দিবে তাই জ্বীনদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য টাকা লাগবে। জ্বীন পরীরা বাদীর কাছে যেতে মানুষের রুপ ধারন করতে হবে সে জন্য জ্বীন পরীদের আগুন মোয়া শাড়ী লাগবে এবং তাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগবে। পরবর্তীতে জ্বীনেরা বাদীর নিকট যাওয়ার সময় পথিমধ্যে খবিশ জ্বীনেরা তাদের উপর প্রসাব করে দিয়েছে তাতে জ্বীনেরা আটকিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে তাদের ছাড়াতে হলে পাঠা বলি দিতে হবে জানিয়ে নানা কৌশলে ধাপে ধাপে প্রতারনার মাধ্যমে সাধারন মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এই জ্বীনের বাদশার কাজ।
তিনি আরও বলেন, হতাশাগ্রন্থ লোকদেরকে প্রতারক চক্রের বাধ্য করার জন্য তাদের কথামতো কাজ না করলে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করা জ্বীন-পরীর বিভৎস ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো এবং কাউকে কিছু বললে সন্তানের মুখ দিয়ে রক্তবমি হয়ে সন্তান মারা যাবে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মারাত্মক ক্ষতিসহ অঙ্গহানী হবে জানিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
জ্বীনের কন্ঠ নকলের তথ্য তুলে দরে তিনি বলেন, অ্যপসের মাধ্যমে প্রতারনার অংশ হিসেবে জৈনপুরী মা ফাতেমা নারী কন্ঠে ভয়েজ দিয়ে পুরুষ প্রতারক কথা বলে এবং জ্বীনের বাদশার কণ্ঠ ভয়েজে দিয়ে ব্যবহার করে মানুষকে বিশ্বাসযোগ্য করে ভয়, আতংক ও পীরের দরবার বলে চালানো হতো।
চক্রটির বিকাশ বিকাশ নগদের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করে ভূয়া সিম তুলে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন ও টাকা নিয়েছে মর্মে স্বীকার করে। তদন্তে বিকাশ স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছে। যেখানে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের জবানবন্দীতে ভয়াবহ, লোমহর্ষক, চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে জানিয়ে এনায়েত বলেন, আসামিদের সাথে তাদের প্রতারনার কাজে আরো একাধিক আসামী জড়িত রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামীসহ প্রতারকচক্র গত ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ৭ বছর প্রতারনা করে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে প্রতারনার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এসময় তাদের কাছ থেকে, মোবাইল ৪টি, লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ভিডিও ৩টি, আসামীদের সাথে বিভিন্ন ভিকটিমের কথা বলার ভয়েস রেকর্ড ১০টি, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবি ৭টি, বিকাশ স্টেটমেন্ট ১৫০ পাতা ও কোটি কোটি টাকার লেনদেনের ৫টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট সনাক্ত করার কথা জানানো হয়।
ডিআই/এসকে