
আব্দুল মজিদ মল্লিক,আত্রাই (নওগাঁ) থেকে: বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মানেই বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ মেলা। এই মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে রঙিন কাগজের তৈরি বিভিন্ন ফুল। বর্তমানে সেই আকর্ষণীয় ফুলগুলো তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। দেশের মধ্যে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার জামগ্রামেতেই এই ফুলগুলো বেশিরভাগ তৈরি হয়ে থাকে। এই গ্রামের বাসিন্দাদের বাপ-দাদাদের পেশা হচ্ছে এই ফুল তৈরি। তবে কালের বিবর্তনে নানা কারণে অনেকেই এই পেশা ছাড়ছে।
গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে কেউ রোদে রং করা রঙিন কাগজগুলো শুকাচ্ছে আবার নারী-পুরুষরা গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে তৈরি করছে ফুল। এই গ্রামে তৈরি হয় অন্তত ৩০ ধরনের মনকাড়া রঙিন কাগজের ফুল—টাইম, সূর্যমুখী, মানিক চান, গোলাপ, শাপলা, কলস, শিকল, বিস্কুট, ঘূর্ণি, চরকি, স্টার, জবা থেকে শুরু করে মেয়েদের মাথার ব্যান্ডের মতো আকর্ষণীয় ডিজাইনও।
এই গ্রামের অন্তত ৩০০-৩৫০ পরিবার এই ফুল তৈরি করে জীবন-যাপন করে আসছে। গ্রামের বাসিন্দারা অধিকাংশই গরীব এবং এই অঞ্চলের জমিগুলোতে বছরে একটি ফসল হওয়ার কারণে পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে কাটাতে হয় তাদের। যে কারণে দিন দিন লাভ কমে গেলেও আজও ঐতিহ্যবাহী এই ফুল তৈরির পেশাটি ধরে রেখেছে। বিশেষ করে নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে এই ফুলগুলো তৈরি করে থাকে। আর পুরুষেরা সারা বছরই বিভিন্ন মেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুলগুলো ফেরি করে বিক্রি করে থাকে। তবে বৈশাখের মেলাতে এই ফুলগুলোর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
তবে বর্তমানে ফুল তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে। যদিও বাপ-দাদার এই পেশাটি পেট চালানোর তাগিদে ধরে রেখেছে অনেকেই। আবার এই ব্যবসা ধরে রাখতে ঋণগ্রস্ত হয়ে অনেকেই গ্রাম ছাড়া হয়েছেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যদি এই কারিগরদের বিনা সুদে ঋণ কিংবা অন্য সহযোগিতা প্রদান করা হতো তাহলে শতবছরের এই গ্রামীণ শিল্পটি আরও প্রসারিত হতো বলে মনে করছেন ফুল তৈরির কারিগররা। হারানোর পথে এই বাঙালির নিজস্ব বিভিন্ন গ্রামীণ লোকজ শিল্পকে বাঁচাতে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সহযোগিতা করার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
ফুল তৈরির কারিগর বাসন্তী রাণী বলেন, এই অঞ্চলের জমিগুলোতে একবার ফসল হয়। সেটা দিয়ে তো আর জীবন চলে না। যার কারণে ফুল তৈরি করে বিক্রি করে যে আয় হয় সেটা দিয়েই সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে হয়। তবে বর্তমানে লাভ বেশ কমে গেছে। তবুও অযথা বসে না থেকে সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে এই ফুল তৈরি করি। এতে করে যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবার নিয়ে কোনমতে টিকে আছি।
আরেক ফুল ব্যবসায়ী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে ফুল তৈরির উপকরণগুলোর দাম কম ছিলো। তাই ফুল বিক্রি করে লাভ হতো ভালোই। তবে বর্তমানে উপকরণগুলোর দাম বৃদ্ধি পেলেও ফুলের দাম তেমন একটা বৃদ্ধি পায়নি। তাই লাভের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। তবুও জীবিকার তাগিদে আমরা বাপ-দাদার এই পেশাটি ধরে রেখেছি। আবার যুগের আধুনিকতার কারণেও ব্যবসার যৌবন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এই ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকেই উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে গ্রামছাড়া হয়েছেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যদি বিনা সুদে ঋণ পাওয়া যেতো তাহলে শতবছরের এই ঐতিহ্যটি আগামীতেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কামাল হোসেন জানান, বাঙ্গালির লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ পহেলা বৈশাখ। আর পহেলা বৈশাখ মানেই গ্রামে গ্রামে গ্রামীণ মেলা বসা। গ্রামীণ মেলা মানেই হরেক রকমের শিল্পের সমাহার। সেই সমাহারের প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাগজের তৈরি বিভিন্ন রকমের কৃত্রিম রঙিন ফুল। ফেরিওয়ালার হাতে থাকা লাঠির মাথায় চমৎকার করে সাজানো কাগজের তৈরি বিভিন্ন রঙিন ফুল যা সহজেই শিশুদের মন কাড়ে। শিশু থেকে শুরু করে বড়দের হাতে, বিশেষ করে মেয়েদের মাথায় এই সব রঙিন ফুল না থাকলে যেন বৈশাখী মেলার পরিপূর্ণতা পায় না। এছাড়াও ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনেও এই কৃত্রিম রঙিন কাগজের ফুলের কোন জুড়ি নেই।
তিনি আরও বলেন, এই শিল্পটি অনেক পুরানো একটি গ্রামীণ শিল্প। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছেন। এই শিল্প ও শিল্পের কারিগরদের বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করাসহ সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে দ্রুতই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।