
সাইদ সাজু, তানোর থেকে ঃ রাজশাহীর তানোরে টুংটাং শব্দে মুখর বিভিন্ন কামারপাড়া ও গোল্লাপাড়া বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারের কামার পট্টী। বছরের অন্য সময় অনেকটা অলস কাটালেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মকার পল্লীর কামারসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও। এলাকার কামাররা ছুরি, চাপাতি, দা, বটি, হাসুয়া, কুড়াল ইত্যাদি তৈরি করছেন। ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে কামার পরিবার গুলোর নারী ও শিশুরাও কাজে হাত লাগাচ্ছেন। বছরের ঈদের আগে এই সময়টাতে কামারদের আয় ভালো হয়। ফলে, টং টাং শব্দে মুখর হয়ে উঠে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কামার পট্টী।
বুধবার দুপুরে সরেজমিনে তানোর সদরের গোল্লা পাড়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকারদের মাত্র ২ টি দোকান তৈরি করা হচ্ছে দা, হাসুয়া, ছুরি, চাকু, চাপলসহ লোহার বিভিন্ন জিনিস। কথা হয়, তানোর সদর গোল্লা পাড়া গ্রামের গোবিন্দ কর্মকারের পুত্র উজ্জল কর্মকারের সাথে তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে এখন আমি আর আমার ভাই গৌতম বাপ দাদার এই পেশা ধরে রেখেছি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আধুনিক সব জিনিস পত্রের কারনে গ্রামের অন্যরা চলে গেছেন অন্য পেশায়। তিনি বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবছর ব্যবসা কম। পুরোনো গুলোই মানুষ ধার করাচ্ছেন বেশী, নতুন গুলো বিক্রি কম।
ঈদের দিন সকালে মুসলিম পরিবারে পশু কোরবানি, চামড়া ছাড়ানো, হাড় ও মাংস কাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাই। কোরবানির কাজে ব্যবহৃত দা, ছেনি, ছুরি, চাপাতি সারা বছর তেমন ব্যবহার না হলেও ঈদের দিনে এসব যন্ত্রের ব্যবহার খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই তো কোরবানিকে সামনে রেখে কামারপাড়া ভিড় বাড়তে শুরু করেছে মুসল্লিদের। ঈদের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে তাল মিলিয়ে ভীড় বাড়তে শুরু করেছে কামার পট্টীতে। ফলে, টুংটাং শব্দে মুখর কামার পট্টী।
সরেজমিনে উপজেলা বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি কামারের দোকানে দা, ছুড়ি, চাপাতি তৈরিতে দিনরাত কাজ করছেন কামাররা। লোহার টুকরা আগুনে পুড়িয়ে সেগুলো পিটিয়ে দা, ছেনিসহ বিভিন্ন লোহার সরঞ্জাম তৈরির টুং টাং শব্দে মুখর কামার পল্লী। কামার পল্লীতে কেউ চুলায় ভাপি (বাতাস দেওয়ার বিশেষ যন্ত্র) টানছে, কেউ লোহা পিটছে, কেউবা শান দিচ্ছে। অনেক কামার দোকানে ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। কামার পাড়ার টুং টাং শব্দ সকাল থেকে শুরু করে চলে গভীর রাত অবধি।
দা ও চাপাতি শান দিতে তানোর বাজারের কামারপল্লীতে আসা শরিফুল ইসলাম বলেন, সারা বছর সংসারে দা ব্যবহার হলেও ছুরি ও চাপাতি গুলো কোরবানির পর অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে। এক বছর সেগুলো ব্যবহার না করায় মরিচায় জং ধরে থাকে। তাই কোরবানি আসলেই দা, ছুরি ও চাপাতির শান দিতে নিয়ে আসি। দা, ছুরি ও চাপাতিতে শান দিতে টাকা একটু বেশি নেয়ার কথা বলছেন ক্রেতারা। ক্রেতারা বলছেন অন্যান্য সময় ৩০ টাকায় দা শান দেওয়া যায় কিন্তু কোরবানির সময় ৪০-৫০ টাকার নিচে শান দেওয়া যায়না। টাকা বেশি দিয়েও যখন-তখন পাওয়া যায় না, ২/৩ দিন পর এসে নিতে হয়।’
চাপাতি কিনতে আসে ক্রেতা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘গত ঈদেও চাপাতি কিনেছিলাম। কিন্তু একদিন ব্যবহারের পর সেগুলো কোথায় আছে খুঁজে পাচ্ছিনা। একটি পেয়েছি তাও মাটিতে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এ বছর আবারও চাপাতি কিনতে এসেছি। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বছর দামও একটু বেশি। কামার সম্প্রদায়ের লোকজন বলেন, লোহার দাম বেশি, কয়লারও দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বছরের ১১ মাসই তেমন কাজ থাকে না। কোরবানির সময় অতিরিক্ত শ্রমিক বেশি টাকা বেতনে কাজে লাগাতে হয়। তাই কোরবানির সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় লোহার সরঞ্জামের দাম একটু বেশি থাকে।
শান দেওয়ার টাকা বেশি নেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নতুন তৈরি করেই তো সময় পাই না। পুরাতন জিনিসে শান দিব কখন? রাত জেগে কাজ করে শ্রমিকরা তাই এই মৌসুমে শান দেওয়ার টাকা বেশি নেন সব কারিগররা। চাপড়া বাজারের ব্যবসায়ী বলেন, আগে শুধু কামার সম্প্রদায়ই এ পেশায় নিয়োজিত ছিল। অনেক পরিশ্রম এ পেশায়, তাই প্রকৃত কামারদের অধিকাংশই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। অন্যান্য শ্রেণি পেশার মানুষকে অতিরিক্ত বেতন দিয়ে এ কাজ করানো হচ্ছে। অন্যান্য সময় দম তেমন বেশি থাকে না, কিন্তু ঈদের মৌসুমে সবাই ২/৪ পয়সা পাওয়ার জন্য কিছুটা বেশি নেয়। দা, ছুড়ি, চাপাতি শান দিয়ে অনেকে খুশি হয়েও ১০-২০ টাকা বেশি দিয়ে যান।