

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি: বালু নদের তীর ঘেঁষা বিশাল বটবৃক্ষ। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে শত বছর ধরে। তীর তীর করে বেড়ে উঠা বটগাছকে ঘিরেই শত বছর ধরে এখানে বসছে গ্রামীণ লোকজ মেলা। কার্তিকের শুরুতে বসে এ মেলা। মেলার পাশাপাশি গত ৪৪ বছর ধরে হয়ে আসছে হিন্দু সম্প্রদায়ের র্কীত্তন অনুষ্ঠান। মেলাটি এখন দশ গাঁয়ের কাছে উত্তরপাড়ার বটতলার মেলা নামেই পরিচিত। ঐতিহাসিক উত্তরপাড়ার মেলার শুরুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে কারো মতে শত বছর। কারো মতে দেড়’শ বছরের মতো। প্রতিবছরের মতো এবারও বটতলায় বসেছে মেলা। বুধবার থেকে শুরু হওয়া এ মেলা টানা সাতদিনব্যাপি চলবে বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা জানান, এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ বটতলা পূণ্য স্থানে পরিণত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে প্রতিবছর কার্তিকের প্রথম দিকে পূজার আয়োজন করে। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা প্রতি বছর এসে সমাগত হতে থাকে। পূজা-পার্বণ মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও মেলাটি ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষকে উৎসবে একত্র করে। আজ অবধি এটি সকল ধর্মের হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল জনসমাগম।বৃহস্পতিবার মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে উত্তরপাড়া ও আশপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা এসে জড়ো হয়। চারিদিকে উৎসব মুখর অবস্থা বিরাজ করে। মেলায় কাঠের, স্টিল ও লোহার বিভিন্ন ডিজাইনের আসববাপত্র সূলভ মূল্যে পাওয়া যায়। মেলায় বিভিন্ন জেলা হতে লোকজন উন্নতমানের কসমেটিক, খেলনা, গিফট সামগ্রীর দোকান বসায়। সাধারণত শিশু এবং মহিলাদের ভিড় লেগে থাকে। আছে চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকাপ বক্স সহ সকল সাজার জিনিস। খেলনার মধ্যে থাকে ব্যাট, বল ভিডিও গেমস ইত্যাদি। মেলার অন্যতম আকর্ষণ মিষ্টি। রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপী, নিমকি, তিলের নাড়–, খই, শুকনা মিষ্টি। এ মেলার আকর্ষণীয় হলো বালুশা, গজা, আমিত্তি মিষ্টি। থাকে বালিশ মিষ্টিও। মেলায় লোকজনের খাওয়া-দাওয়ার জন্য বসানো হয় অস্থায়ী হোটেল, আছে ফুচকা চটপটি, ভাজা-পোড়া ও আইসক্রিমের দোকান। মাংস, কাঁচাবাজার, মসলা, গৃহস্থালীর দৈনন্দিন জিনিসপত্র যেমন ছুরি, দা, বটি এগুলোও পাওয়া যায়। মেলায় কেনাকাটার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। ছোটদের জন্য নাগড়দোলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
শুধু তাই নয়। মেলায় আগত লোকজনের জন্য মেলার আয়োজন কমিটি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। টানা সাতদিন চলে কাটারিভোগ চাউলের ভাত, সবজি, ডাউল। আর শেষ দিন থাকে পোলাও, সবজি, ডাউল। হিন্দু-মুসলিম সবাই এ খাবার খায়। সকাল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত চলে রান্নাবান্না। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ খাওয়া-ধাওয়া করে। পাশাপাশি মেলায় যারা দোকানদার আসে তারাও এখানে খেতে পারে।রাশেক আহমেদ রাহিদ ও রওনক আহমেদ রাশিদ দুই ভাই। তারা বলে, প্রতি বছর এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। গ্রামীণ মেলায় সবার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের জিনিসপত্র, খাবার দাবার পাওয়া যায়। ভালো লাগে। ঢাকার সাতারকুল থেকে এসেছে তানহা আর তাহা। তারা বলেন, আমার নানু বাড়ি এখানে। এ বটতলার মেলা শুরু হলেই আমরা নানু বাড়িতে বেড়াতে আসি। অনেক ভাল লাগে এ মেলায়। আনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, আমরা ছোটবেলা থেইক্যা এ মেলায় আহি। অনেক জমে মেলা। আড়াইহাজার থেকে আসা গৃহবধূ অঞ্জনা রাণী সরকার বলেন, মেলা শুরু হলে আড়াইহাজার থেকে চলে আসি। অনেক ভাল লাগে। কসমেটিক দোকানদার কেরামত আলী বলেন, ২৮ বছর ধইরা এ মেলায় ব্যবসা করতাছি। বাবার মুহে হুনছি এ মেলার বয়স ১০০ বছরের উপরে। কোন গ্যাঞ্জাম অয় না। আর কোন টেকা-পয়সা দেওন লাগে না। মিষ্টি ব্যবসায়ী সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, আমি মিষ্টি বেঁচি ২৫ বছর ধইরা। এই মেলায় রূপগঞ্জের মানুষের পাশাপাশি ঢাকার ত্রিমহনী, ফকিরখালী, বেরাইদ, মাদারটেক, নন্দিপাড়া এলাকার লোকজন আহে। মেলায় কীত্তন গাইতে আসা বরিশালের বাকেরগঞ্জের নকুল কুমার বিশ্বাস বলেন, ২০ বছর ধরে মেলায় আসি। অনেক ভাল লাগে। অনেক ভাল পরিবেশ। মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি দুলাল বিশ্বাস, জগৎ চন্দ্র সরকার ও কালিপদ রায় বলেন, আসলে মেলাটায় অনেক খরচ। সাতদিন মেলায় ৯ টা দল র্কীত্তন করে। সারাদিন খাওয়া চলে। অনেক খরচ। অনেক কষ্ট কইরা ধইরা রাখছি। সরকারী সাহায্য পাইলে আরো সুন্দর অইতো।