

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ, একটা এলাকার জন্য ১৬ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন হলেও রূপগঞ্জে ২ ভাগও বনভূমি নাই। রাজধানী ঢাকার কাছে বলেই আবাসনের চাপ পড়েছে রূপগঞ্জে। নগরায়ণ, শিল্পায়ান, আবাসনের নামে জলাভূমি বালি ফেলে সবুজায়ান ধ্বংস করে ফেলছে। লোকে বলে আবাসনের জন্য নগরায়ণ শিল্পায়নে গিলে খাচ্ছে রূপগঞ্জের সবুজায়ন। জানা যায়, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ ১৮ জন মানুষের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন জোগায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ লিটার অক্সিজেন ব্যবহার করেন, যার বাজারমূল্য লাখ টাকারও বেশি। বন কর্মকর্তা সঞ্জয় হাওলাদারের মতে, একজন মানুষ বছরে প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার অক্সিজেন বিনামূল্যে পান। গড় আয়ু ৫৬ বছর ধরা হলে, একজন মানুষ জীবদ্দশায় ২ কোটিরও বেশি টাকার অক্সিজেন গ্রহণ করেন।
রিপন মিয়া বলেন, আমাদের পূর্বাচলে একটা সময় সবুজের সমারোহ ছিল। ছায়া দিত মন জুরাত অক্সিজেনের ফ্যাক্টরিগুলো। এমন কোন ফলজ বনজ গাছ ছিল না যা পূর্বাচলে ছিল না। ইছাপুরার সবজি ঢাকা শহরসহ বিদেশেও রপ্তানি হত। ইছাপুরার সবজি মানেই স্বাদে অনন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পূর্বাচল আধুনিক শহরের নামে সবুজায়ান ধ্বংসের ফলে সেই ছায়া সুনিবির পূর্বাচল এখন আর নেই। আর ফলমুল সবজি তো এখন স্বপ্ন। আধুনিক শহর আমাদের সবুজকে গিলে ফেলেছে।
গত এক দশকে উপজেলায় শিল্পায়ন, শহরায়ন ও সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের নামে প্রায় ছয় লাখ গাছ উজাড় হয়েছে। অথচ একই সময়ে উপজেলা পর্যায়ের বাজেটে বনায়নের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। বন অফিসগুলো বর্ষায় সামান্য কিছু চারা বিতরণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। ব্যক্তি পর্যায়েও গাছ লাগানোর উদ্যোগ প্রায় দেখা যায় না। ফলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, দ্রুত সবুজায়ন না হলে নারায়ণগঞ্জে আগামী দুই দশকে অক্সিজেন সংকট দেখা দিতে পারে।
রূপগঞ্জের আয়তন ১৭৬ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা বন অফিসের হিসাব বলছে, উপজেলায় গত ১০ বছরে ৩ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। কিন্তু লাগানো হয়নি এমনকি ৫০ হাজার গাছও। সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার কোনো অস্তিত্ব আজ নেই।
পুরোনো গাছগুলোর ৭০ শতাংশ কেটে ফেলা হয়েছে, লক্ষ্যাধিক গাছ সঠিক পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে। গত পাঁচ বছরে সামাজিক বন বিভাগ সড়কের ধারে মাত্র ৮ হাজার ৬০০ গাছ রোপণ করেছিল, যার অধিকাংশ এখন হারিয়ে গেছে।
রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহর নির্মাণে প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর বনভূমি উজাড় করা হয়, যেখানে শতবর্ষী শালগাছও ছিল। বিষয়টি আদালতের নজরে এলে হাইকোর্ট গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা দেন। কিন্তু রাজউকের নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ওই এলাকার বনভূমি মাত্র ৫.৭ শতাংশ দেখানো হলেও বাস্তবে তা ছিল ৪২.৭৬ শতাংশ।
২০১৮ সালে এশিয়ান বাইপাস সড়ক সম্প্রসারণে প্রায় ২ হাজার ৮০০ গাছ কাটা হয়। সম্প্রতি রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে নগর পর্যন্ত সড়কের ধারে ৭৫টি চাম্বল গাছ কাটার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার মধ্যে ইতোমধ্যেই ১০টি কেটে ফেলা হয়েছে। এমনকি একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরির জন্যও গাছ কাটা হয়েছে।
পরিবেশ আন্দোলন ‘গ্রিন ভয়েজ’-এর সভাপতি আলমগীর কবিরের ভাষায়, ‘গাছ কাটা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনই গরম আবহাওয়ার প্রধান কারণ।’
মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক মো. ইসহাক মিয়া বলেন, বন উজাড়ের ফলে বায়ুম-ল থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করার মতো গাছ আর থাকছে না। এতে ক্ষতিকর গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ছে, অক্সিজেন কমছে, বিলুপ্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক নুরুজ্জামান বলেন, ‘একটা গাছ কাটলে অন্তত দুটি গাছ লাগানো জরুরি। না হলে পরিবেশের ভারসাম্য টিকবে না।’
বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক শরীফ উদ্দিন সবুজ বলেন, বৃক্ষ বাষ্পমোচন ও ঘনীভবনের মাধ্যমে বৃষ্টি আনে। ফলে গাছ কমে গেলে বৃষ্টিপাতও হ্রাস পায়, তাপমাত্রা বেড়ে যায়, এমনকি বন্যাও বাড়ে।
রূপগঞ্জ উপজেলা বন কর্মকর্তা সঞ্জয় হাওলাদার স্বীকার করেছেন, ‘আমরা গাছ লাগাতে উৎসাহ দিই। কিন্তু নানা কারণে গাছ কাটায় বাধা দেওয়া যায় না।’ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহম্মদ হাফিজুর রহমানও দায় এড়িয়ে বলেন, ‘গাছ লাগানো বন বিভাগের দায়িত্ব।’ বন অধিদপ্তরের সহকারী বন সংরক্ষক ব্রজ গোপাল রাজবংশী জানান, রাস্তা সম্প্রসারণের কারণে সামাজিক বনায়ন বন্ধ হয়ে আছে, তবে নতুন কোনো বনায়ন হয়নি।