

নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
ফ্যাসিস্ট আ’লীগ সরকারের পতনের দিন গত ৫ই আগস্ট মিরপুরের শ্রাবণ হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা,আসাদুজ্জমান নূর, ইরেশ যাকেরসহ ৪০৭ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ আনেন মামলার বাদী। শ্রাবণের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী গত ২৭ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগ ও জবানবন্দির ভিত্তিতে মিরপুর মডেল থানার ওসিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেয় আদালত। মামলার বর্ণনায় উঠে আসে কিভাবে পুলিশ ও আওয়ামী দুর্বৃত্তরা রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুলাই আগস্ট মাসে আন্দোলন দমনের নামে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে।
জানা যায়,সম্প্রতি দুইজন উপদেষ্টার প্রভাবে মিরপুর থানা তদন্তকারী কর্মকর্তা সম্পুর্ন অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনার মাধ্যমে এশিয়াটিকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ইরেশ যাকের ও ইকরাম মইন চৌধুরীকে শ্রাবন হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছেন। সুপারিশে ইরেশ ও ইকরাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এরকম কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে গত ৯ অক্টোবর আদালতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দাখিল করে অব্যাহতি চেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক সাজ্জাদ রোমন। তার দেয়া প্রতিবেদনে বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন গোষ্ঠী এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির এমডি ইরেশের সঙ্গে সহযোগী কোম্পানি ফোরথট পিআরের এমডি ইকরাম মঈন চৌধুরীকেও অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। এ প্রতিবেদনে ইরেশ-মঈনকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রশ্নে তিনটি কারণ দেখিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ রোমন।
অথচ মামলায় সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জমান নূর ও তার বিজ্ঞাপন ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন গোষ্ঠী এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির এমডি ইরেশ জাকের,মোর্শেদ আলম ও ইকরাম মঈন চৌধুরীকে আসামী করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তাদের নগ্ন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সকল ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের একক আধিপত্য বিস্তার করে এবং সকল মিডিয়ার নিউজ সরকারের পক্ষে সম্প্রচারে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে। তাদের সকলের সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ইন্ধন ও উস্কানির ফলে আমার ছোট ভাই সহ সকল গণহত্যা কান্ড সংগঠিত হয়েছে।
মামলার ৪০৭ জন আসামির মধ্যে শুধুমাত্র কেন এই দুজনকেই অব্যাহতির সুপারিশ দেয়া হলো এ ব্যাপারে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এরফলে শীর্ষ মিডিয়া সন্ত্রাসী,দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মূল প্রচারকান্ডারী ইকবাল সোবাহান চৌধুরী, মোজাম্মেল বাবু,মুন্নি সাহা,নইম নিজাম,শ্যামল দত্ত,সুভাষ সিংহ রায়,মাসুদা ভাট্টি সহ চিহ্নিত দালালদের একই কারনে এই মামলা ও অন্যান্য মামলায় আসামি করা হলেও ভবিষ্যতে এরকম অন্যান্য হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে জামিন পাওয়ার একটি বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করলো পুলিশ।
একই মামলায় আসামি এশিয়াটিকের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নূর ও অপর আসামী মিডিয়া ইউনিটের এমডি মোরশেদ আলমের ব্যাপারে বিস্ময়কর ভাবে অব্যাহতি চাওয়া হয়নি। ইরেশ ও ইকরামের অব্যাহতি পাওয়ার প্রক্রিয়াটির সফলতা ব্যর্থতা বাকি আসামিদের জন্য একটি এসিড টেস্ট। যদিও আসাদুজ্জামান নূর ২০২৪ এ সেপ্টেম্বরে থেকে বিভিন্ন হত্যা ও দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। অভিযোগ আছে ইরেশ যাকের,মোরশেদ আলম,ইকরাম মইন চৌধুরী হত্যা মামলা দায়েরের খবর প্রশাসনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছ থেকে পেয়ে আগেভাগে গোপনে দেশ ছাড়েন।
গ্রেফতার এড়াতে অর্থের বিনিময়ে মামলার আগেই ২৪শে এপ্রিল উপদেষ্টাদের সহযোগীতায় নেপালে পাড়ি জমান ইরেশ যাকের। একাধিক ব্যক্তি ইরেশ যাকেরকে নেপালের ফ্লাইটে দেখেন বলে জানা গেছে। বাকিরা বিগত ছয় মাস যাবত বিভিন্ন সময়ে ভারত,নেপাল থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপনে আছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়,ইরেশ যাকের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও প্রভাব খাটিয়ে মামলার প্রতিবেদন নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
এরপর পুলিশি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাদীকে চুপ করানো হয় এবং কোটি টাকার বিনিময়ে একটি ভুয়া স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে “ঘটনাস্থলে ইরেশ যাকের উপস্থিত ছিলেন না।” বিদেশ থেকে ব্লগ পরিচালনাকারী শাহবাগী নেতা ওমি রহমান পিয়াল তার ফেইসবুক পোস্টে এই অব্যাহতির ঘটনায় উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সরাসরি জড়িত থাকা ও ৩০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য দেন। এছাড়া তার পোস্টে মামলা থেকে রক্ষায় ইরেশ ও এশিয়াটিকের সম্পদের মালিকানা বদল ও অস্বাভাবিক লেনদেনেরও ইঙ্গিত দেন।
বিগত আওয়ামী আমলে সরকারি বিজ্ঞাপন বানানো,প্রচার, ইভেন্ট এর হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, একতরফাভাবে করে আসছিল নুর ইরেশ এর এশিয়াটিক গ্রুপ। প্রতিদান হিসেবে জুলাই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে শমী কাউসার,রিয়াজ,ফেরদৌস,রোকেয়া প্রাচী,সোহানা সাবাসহ প্রমুখ অভিনয় শিল্পীদের সম্পৃক্ত করে “আলো আসবেই” গ্রুপের সদস্যদের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতের নির্দেশে টাকা বিলি করেন ইরেশ। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের অপতথ্য ছড়াতে বট আইডি দিয়ে শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের কাজ করছিল এশিয়াটিক এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এইসব কাজ সমন্বয় করছিলেন ইরেশ জাকের।
সরকারবিরোধী আন্দোলন চুড়ান্ত পর্যায়ে “দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ” এর অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে আজমেরি হক বাঁধন,আশফাক নিপুণ,অমিতাভ রেজা, মোশাররফ করিমদের সাথে প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন চতুর ইরেশ যাকেরও। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসিনার দালাল শিল্পীদের অর্থপ্রদানের ঘটনা ও ওয়াটস অ্যাপ এর তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েন ইরেশ।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশে এশিয়াটিক গ্রুপকে ঢাকায় নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর ও মুজিব বর্ষ নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের কাজ দেয়া হয়। এছাড়া হাসিনা রেজিমের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় বিগত আমলে মুজিব সিনেমা, কনসার্ট বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনের কাজ এশিয়াটিক দেশে বিদেশে প্রচার করতো। এই কাজে সরকারি মন্ত্রী ও আমলাদের সাথে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন,বিদেশে টাকা পাচার ও ব্যাপক কর ফাঁকির অভিযোগ উঠে এশিয়াটিক গ্রুপ ও তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অবৈধ সম্পদ অর্জন,টাকা পাচার ও কর ফাঁকি উদঘাটনে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল এশিয়াটিকের ১৭ টি কোম্পানি ও শীর্ষ আট কর্মকর্তার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করার আদেশ দেয়। এছাড়া হাইকোর্টে একটি দ্বৈত বেঞ্চ এশিয়াটিক গ্রুপের করফাঁকি,অর্থ পাচার ও ঘুষ দুর্নীতি মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের বিষয়ে আলাদা আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এনবিআর বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদককে নির্দেশ দেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত এশিয়াটিক গ্রুপের মানবাধিকার লংঘন, অপকর্ম ও দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদের সত্যতা পাওয়ায় গত জুলাই মাসে ব্রিটিশ বহুজাতিক বিজ্ঞাপনী গ্রুপ ডব্লিউ পি পি এশিয়াটিক গ্রুপের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন এবং কালো তালিকাভুক্ত করে।