নয়ন হোসেন,হরিপুর প্রতিনিধিঃ
হরিপুর উপজেলা বাসি ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তবর্তী একটি জনপদ। মানুষের মেধা ও শ্রম থাকলেও এই অঞ্চল এখনও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের ধারায় আসতে পারেনি। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই,, হরিপুরের পিছিয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক বাস্তব ও কাঠামোগত কারণ। নিচে সেগুলো সহজভাবে তুলে ধরা হলো:
ভৌগোলিক বাঁধা : বিচ্ছিন্নতা আর অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্রবিন্দু
হরিপুর সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় এর বহু জায়গা দুর্গম এবং প্রশাসনিকভাবে বিচ্ছিন্ন। যেমন গেদুড়া, ভাতুরিয়া এলাকাগুলোর সঙ্গে উপজেলার যোগাযোগ অত্যন্ত দুর্বল। বরং মানুষ প্রয়োজন হলে রাণীসংকৈল, পীরগঞ্জ দিনাজপুরে চলে যায়।
ফলে— পরিকল্পিত উন্নয়ন হয় না, প্রশাসনিক মনোযোগ কমে যায়, কেন্দ্রীয় কোনো বিকাশকেন্দ্র তৈরি হয় না।
রাজনৈতিক অবহেলা : একপাক্ষিক নেতৃত্ব, বঞ্চিত হরিপুর। স্বাধীনতার পর থেকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে বারবার এক এলাকা থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। হরিপুর বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে।
হরিপুরের চাহিদা, সমস্যা এবং সম্ভাবনা কেউ তুলে ধরেননি। স্থানীয় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। অন্য এলাকা থেকে নেতৃত্ব আসায় হরিপুরের ভাগ্য নির্ধারিত হয় বহিরাগতদের হাতে।
উন্নয়ন দর্শনের সংকট ও নেতৃত্বহীনতা
উন্নয়ন শুধু রাস্তা, বিল্ডিং বা গেট নির্মাণ নয়। উন্নয়ন হলো মানুষের জীবনমান পরিবর্তন, সুযোগ তৈরি করা। হরিপুরে এই “উন্নয়ন দর্শনের”ই ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজন বিবেচনায় নয়, বরং বরাদ্দ খরচ করাই এখানে “উন্নয়ন” হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিকভাবে গড়ে তোলা হয়নি, নেতৃত্ব এসেছে স্বজনপ্রীতি ও প্রভাবের মাধ্যমে।
এই কারণে — প্রকল্প থাকে, কাজ থাকে না।
সম্পদ ব্যয় হয়, উন্নতি হয় না।
মানুষ নিরুৎসাহিত হয়, নেতার ওপর আস্থা হারায়।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা হরিপুরে কোনো শিল্প নেই, আধুনিক বাজার নেই, পর্যটন সম্পদ থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ফলে—কর্মসংস্থান তৈরি হয় না।
কৃষি পণ্যের মূল্য ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পান।
হরিপুর জমিদারবাড়িকে তাজহাট জমিদার বাড়ির আদলে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রুপান্তর করা। যাদুরাণী হাট উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা, নাগর নদী কেন্দ্র করে ইকো পার্ক এবং সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য একটি স্থলবন্দর হরিপুরকে অর্থনৈতিক কেন্দ্র বানাতে পারে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা।
উপজেলার এখনো অনেক রাস্তা এখনো কাঁচা। ইউনিয়নের সাথে উপজেলা শহরের যোগাযোগ দুর্বল। বর্ষায় রাস্তাঘাট প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
স্বাস্থ্যসেবার সংকট,
মাত্র একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।সকলের রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই, সীমান্তবর্তী হওয়ায় চিকিৎসা প্রযুক্তি কম এবং ডাক্তারের যোগদানের পরেই বদলীর তকবির শুরু হয়ে যায়। মাত্র ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রোগীদের জায়গা সংকুলান হয়না। ওষুধ ও জরুরি সেবা অপ্রতুল।
ফলে সামান্য অসুস্থতায়ও মানুষ ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও রংপুরে ছুটে যেতে বাধ্য হয়।
শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি,
অনেক স্কুল আছে, মানসম্পন্ন শিক্ষক ও পরিবেশ নেই। ইংরেজি, বিজ্ঞান, আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষায় দুর্বলতা রয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য দূরের কলেজে যেতে হয়।
ফলে দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না।
ইন্টারনেট সুবিধা সীমিত, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল সেবা ঘাটতি, অনলাইন সেবা বা শিক্ষায় পিছিয়ে। ফলে ছাত্র, চাকরিপ্রার্থী, উদ্যোক্তা — সবাই পিছিয়ে থাকছে।
করণীয় : হরিপুরকে বদলাতে হলে যা প্রয়োজন
স্থানীয় সমস্যা বুঝে বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা।
নেতৃত্বে নতুন, শিক্ষিত ও সাহসী তরুণদের অংশগ্রহণ।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগে অগ্রাধিকার ভিত্তিক বাজেট।
সীমান্ত অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক জোন তৈরি।
জনগণের অংশগ্রহণে বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
হরিপুরের পিছিয়ে পড়া কোনো দৈব ঘটনা নয়। এটি এক দীর্ঘদিনের অবহেলা, দুর্বল নেতৃত্ব ও ভুল উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির ফল। এই ধারা বদলাতে হলে শুধু সরকার নয়, স্থানীয় নেতৃত্ব, প্রশাসন এবং জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
এই লেখাটি সম্পূর্ণরূপে আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ভিত্তিক রচনা। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং হরিপুরের বাস্তব সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য এটি রচিত।