

মেহেদী হাসান রিপন,স্টাফ রিপোর্টারঃ “যশোরের যশ, খেজুরের রস” – এই প্রবাদটি আবহমানকাল ধরে প্রচলিত। গ্রামীণ জনপদে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে খেজুরের রস। আর এই সুস্বাদু রস সংগ্রহের পূর্বপ্রস্তুতি নিতেই এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় পার করছেন যশোরের বাঘারপাড়ার গাছিরা। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাছের মাথায় উঠে ধারালো দা দিয়ে চলছে খেজুর গাছের পরিচর্যা ও ‘চাঁচ’ দেওয়ার কাজ।শীতের ভরা মৌসুম শুরুর আগেই বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা, মহিরন, লক্ষীপুর, নারিকেলবাড়ীয়া এবং খাজুরা অঞ্চলের গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করার কাজে হাত দিয়েছেন। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের আগার সোনালী অংশ বের করে আনার এই প্রক্রিয়াকে স্থানীয় ভাষায় ‘চাঁচ দেওয়া’ বা ‘গাছ তোলা’ বলা হয়। একজন অভিজ্ঞ গাছি ধারালো ‘গাছি দা’ দিয়ে অত্যন্ত নিপুণ হাতে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেন। গাছ চাঁচার ৮ থেকে ১৪ দিন পর সেখানে বাঁশের তৈরি নলি স্থাপন করা হবে এবং মাটির ভাঁড় (ঠিলে) বেঁধে রস সংগ্রহ শুরু হবে। সাধারণত নভেম্বর মাস থেকেই সুস্বাদু খেজুর রস আহরণের মূল কাজ শুরু হয়।শীত যত বাড়ে, খেজুর রসের মিষ্টিও তত বাড়ে। শীতের সকালে এক ভাঁড় কাঁচা রস বা সেই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পিঠা-পুলি ও পায়েস গ্রামের মানুষের প্রধান আকর্ষণ। বাঘারপাড়া খেজুরের গুড়-পাটালি তৈরির জন্য বিখ্যাত। এই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় লোভনীয় গুড় ও পাটালি, যার ঘ্রাণে চারদিক ম-ম করে। এখানকার খাজুরা অঞ্চলের পাটালি গুড়ের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। অনেক কৃষক এবং গাছি শীতের এই ৪ মাস রস বিক্রি ও গুড় তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তবে কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্য কিছুটা সংকটের মুখে পড়েছে। পরিবেশ দূষণ, অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসন ও রাস্তা তৈরির কারণে দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। একইসাথে, এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম থাকায় গাছিদের সংখ্যাও কমছে। বাঘারপাড়া উপজেলাতেই পূর্ণ বয়স্ক ৫ লাখ ৫৪ হাজার খেজুর গাছ থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৪৫ হাজার গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় বলে জানা গেছে। গাছিরা জানান, কষ্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও শ্রম অনুযায়ী গুড়ের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াটাও এই শিল্প ধরে রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।তবে এই সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, শীতের আগমনী বার্তায় গাছিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সচেষ্ট। প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে খেজুর গাছের চারা রোপণ ও গাছিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে।