

রূপগঞ্জের তাবিজ যেত সৌদী দুবাইসহ বিলেতেও
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ “ ও মোর বানিয়া বন্ধুরে একটা মাধুলি বানাইয়া দে, একটা তাবিজ বানাইয়া দে, মরিয়া গিয়াছে হিয়ারও সোয়ামী স্বপনে আইছে/ কি তাবিজ করিলা বন্ধুরে ঘরেতে মন বসে না/ কি যাদু করিলা তাবিজও করিয়া, সয়নে স্বপনে শুধু তোমারে দেখি যে– শিল্পির গানের মত করে এখন আর কোন প্রেমিক প্রেমিকা একজন আরেকজনকে বশে আনতে বানিয়া বা কারিগরের কাছে তাবিজ বা মাধুলি বানাতে যায় না। ইন্টরনেট, হোয়াটসএ্যাপের যুগে তাবিজের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
ডেমরা-কালীগঞ্জ সড়কের পাশ ঘেষেই রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের টান মুশুরী গ্রাম। এছাড়া এর পার্শ্ববর্তী ভিংরাব, চোরাব ও দক্ষিণবাগ গ্রামেই তাবিজ তৈরির কারখানাগুলো গড়ে উঠেছিল। সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়ে মিলেছে নানা কারণ। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগে এই শিল্পের ব্যবহার কমে যাওয়া। আগে গ্রামেগঞ্জে তথা শহরেও রোগ-বালাইয়ের জন্য কবিরাজি দেখানো হতো। বিজ্ঞানের যুগের আবিভাবের ফলে কবিরাজি প্রথা নেই বললেই চলে। ফলে অনেক কবিরাজও তাদের কবিরাজি পেশা ছেড়ে দিয়েছে। ফলে কমে গেছে তাবিজের ব্যবহার। তবে গ্রামগঞ্জে এখনও কবিরাজদের প্রথা রয়ে গেছে। তাই অদ্ভুদ পেশার তাবিজ তৈরির কারিগরেরা পেটের তাগিদে ও বাপ-দাদার আমলের পেশাকে আকড়ে ধরে রাখতে এ ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
“এখন আর মাধুলী তাবিজ কবজের ব্যবহার তেমন একটা নেই বললেই চলে। আধুনিক যুগে রোগ নির্ণয়ের অনেক প্রযুক্তি আবিস্কার হচ্ছে হরহামেশাই। একটা সময় ছিল অসুখ বিসুখ হলেই মানুষ কবিরাজের শ^রনাপন্ন হত। ঘরে ঘরে এত ডাক্তার, ফার্মেসী ছিল না। কবিরাজ ঝাড় ফুঁয়ের পাশপাশি তাবিজ কবজ দিতেন। এক সময় উপজেলায় তাবিজ কবজের রমরমা ব্যবসা ছিল।” কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার খামারপাড়া গ্রামের কফিল উদ্দিন ভুইয়া।
২০০ বছর ধরে রূপগঞ্জের মুশরী, ভিংরাবো ও চোরাব এলাকার দেড় শতাধিক পরিবার লোহার তাবিজ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাবিজে ভাগ্যবদল হয় এমনটা তারা মনে করলেও এখানকার শত শত তাবিজ তৈরি কারিগরদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ঝাঁড়-ফুকের ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাবিজ ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে।
প্রেমিককে বশে আনার জন্য বানিয়ার দোকানে গিয়ে এখন আর প্রেমিকা আগের মত বলে না, ওমোর বানিয়্যা বন্ধুরে একটা তাবিজ বানাইয়্যা দে। এখানকার ৭০ ভাগের বেশি কারখানা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। কারিগররা জানান, প্রায় ১৫০ বছর আগে সুরেশ নীরঞ্জন তাবিজ তৈরির কৌশল রপ্ত করেন। আজ সুরেশ নীরঞ্জন নেই। রয়ে গেছে তার স্মৃতি।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে এক সময় রূপগঞ্জের তাবিজ যেত বিলাতে( লন্ডন)। এছাড়া ভারতের কামরু কামাখ্খা, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, পাকিস্তান, ভুটান, ইরাক-ইরান, ও সৌদিতে যাচ্ছে এখানকার তাবিজ।
দক্ষিনবাগ এলাকার কবিরাজ নায়েব আলী মিয়া জানান, বিজ্ঞানের তৈরি ইসিজি, এক্সরে, প্যাথলজি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যুগেও তাবিজের কদর কমেনি। মান্ধাতার আমলে গাও-গেরামের এমনকি শহরেও কবিরাজদের আসক্তি ছিল। রোগবালাই, ভালবাসার মানুষকে বশীকরণসহ বিভিন্ন কাজে কবিরাজরা তাবিজ-তুমার দিতো। এখন তাবিজ-কবজকে বিশ্বাস না করলেও এর ব্যবহার কমেনি। শিশুদের চোরায় ধরা, বান মারা, জাদুটোনা করা ও মনের মানুষকে কাছে পেতে এখনও মানুষ কবিরাজ ও মৌলভীদের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে থাকে।
তাবিজ শিল্প শুধু বিলাতে নয়, বিভিন্ন দেশে রপ্তানী যেন হয় সে-দিকে সরকারের দৃষ্টির প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋনের সুবিধা মিললে এ শিল্প আরো সাফল্যমন্ডিত হবে। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাবিজ শিল্প যাতে টিকে থাকে সে ব্যাপারে আমি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন মহলে বিষয়টা জানাব।